কালাই (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি: বাজারে আলুর দর এতটাই পড়ে গেছে যে বিক্রি করেও হিমাগারের ভাড়ার টাকা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। উল্টো সংরক্ষিত আলু তুলতে গেলে বস্তাপ্রতি পকেট থেকে আরও ২০ টাকা গুনতে হচ্ছে। এই লোকসানের হিসাব কষেই জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বিভিন্ন হিমাগার থেকে আলু তুলতে আসছেন না চাষি ও ব্যবসায়ীরা। ফলে একের পর এক নোটিশ দিয়েও সাড়া না পেয়ে হিমাগার কর্তৃপক্ষ আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সংরক্ষিত আলু বের করে নেওয়ার সময় বেঁধে দিয়ে এলাকায় মাইকিং করেছে।

হিমাগার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আলু নেওয়া না হলে ঠান্ডা সংরক্ষণের মেশিন বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং পরে ওই আলুর কোনো দায় তারা নেবে না। পাশাপাশি সংরক্ষণ ভাড়ার টাকা আদায় করা হবে। তবে বর্তমান বাজার দরে আলু বিক্রি করে সেই ভাড়া পরিশোধ করা সম্ভব না হওয়ায় চাষি ও ব্যবসায়ীরা হিমাগারে যাচ্ছেন না। এতে যেমন চাষিরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন, অন্যদিকে হিমাগার কর্তৃপক্ষও বিপাকে পড়েছে।


এই অবস্থার মধ্যেই গত ১২ ডিসেম্বর শুক্রবার রাজধানীর বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত আলু উৎসব অনুষ্ঠানে কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনকে কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পুরো ডিসেম্বর মাসজুড়ে হিমাগারে আলু সংরক্ষণের অনুরোধ জানান। অথচ, তার পরদিনই জয়পুরহাট জেলায় বিভিন্ন হিমাগার কর্তৃপক্ষ ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আলু তুলে নেওয়ার জন্য মাইকিং করায় চাষিদের মধ্যে ক্ষোভ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত মৌসুমে জয়পুরহাট জেলায় ৪৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়ে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৯ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন। অতিরিক্ত উৎপাদন এবং রপ্তানি কম থাকায় চলতি মৌসুমে আলুর দাম ভয়াবহভাবে কমে গেছে। পাইকারি বাজারে বর্তমানে বিভিন্ন জাতের আলু ৬৫ কেজির প্রতি বস্তা ৩৭০ থেকে ৩৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা মৌসুমের দামের চেয়েও অনেক কম। এ কারণে জেলার ১৯টি হিমাগারই মৌসুমে পরিপূর্ণ থাকলেও বছর শেষে সংরক্ষিত আলুর ২০ শতাংশেরও বেশি আলু এখনও মজুত রয়েছে।
এদিকে বাজারে নতুন আলু উঠতে শুরু করায় পুরাতন আলুর চাহিদা আরও কমে গেছে। বর্তমানে হিমাগার গেইটে পুরাতন আলু ৫ থেকে ৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও নতুন আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২১ টাকা কেজিতে। পুরাতন আলু শেষ না হওয়ায় নতুন আলুর দামও স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। এতে আগাম জাতের আলু চাষিরাও লোকসানের মুখে পড়েছেন।
আলু চাষিরা জানান, গত মৌসুমে এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ১৭ থেকে ১৮ টাকা। হিমাগারে সংরক্ষণ ভাড়া ৬ টাকা ৭৫ পয়সা এবং লেবার, সুতলি, পরিবহন ও লোড-আনলোড মিলিয়ে আরও ২ টাকা ব্যয় হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতি কেজিতে খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২৭ টাকা। অথচ বর্তমানে হিমাগার থেকে আলু বিক্রি করলে ভাড়াসহ দাম মিলছে মাত্র ৫ থেকে ৬ টাকা কেজি। ফলে আলু তুলতে গেলে লাভ তো দূরের কথা, মূলধনের বড় অংশও হারাতে হচ্ছে।
কালাই উপজেলার বেগুনগ্রামের আলু চাষি রেজাউল ইসলাম জানান, মৌসুমে দাম কম থাকায় তিনি ২৫০ বস্তা আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করেছিলেন। মাঝখানে দাম কিছুটা বাড়লেও তখন বিক্রি করলে সামান্য টাকা পাওয়া যেত। এখন আলু তুলতে গেলে উল্টো বস্তাপ্রতি ২০ টাকা করে নিজের পকেট থেকে দিতে হবে, তাই তিনি হিমাগারে যাননি। একই উপজেলার হাতিয়র গ্রামের কৃষক জালালুদ্দিন মন্ডল বলেন, কয়েকদিন ধরে হিমাগারের পক্ষ থেকে মাইকিং করে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আলু নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। না নিলে দায় নেবে না, আবার ভাড়াও দিতে হবে। পুরাতন আলু শেষ হয়নি তার ওপর নতুন আলু বাজারে এসেছে, এই অবস্থায় কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না বলে আক্ষেপ করেন তিনি।
পুনট বাজারের আলু ব্যবসায়ী মিঠু ফকির জানান, তিনি বিভিন্ন হিমাগারে ১৭ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করেছিলেন। কম দামে ইতোমধ্যে ১১ হাজার বস্তা বিক্রি করে প্রায় এক কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এখনও ছয় হাজার বস্তা আলু হিমাগারে রয়েছে। সেগুলো তুললে বর্তমান বাজার দরে আরও প্রায় ৪৪ লাখ টাকা লোকসান হবে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। তাই হিমাগারে যাতায়াত বন্ধ রেখেছেন।
কালাইয়ের পুনট কোল্ডস্টোরেজের সহকারী ব্যবস্থাপক এনামুল হক বলেন, গড়ে এখনও সংরক্ষণের প্রায় ২০ শতাংশ আলু হিমাগারে মজুত রয়েছে। নতুন আলু বাজারে আসায় পুরাতন আলুর দাম ও চাহিদা কমে গেছে। পাশাপাশি হিমাগার পরিষ্কার করার প্রয়োজন রয়েছে। এ কারণেই মালিকপক্ষের নির্দেশে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আলু নিয়ে যেতে মাইকিং করা হয়েছে। এরপরও কেউ না এলে মেশিন বন্ধ করে আলু বের করে রাখা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক আল মামুন মিয়া বলেন, হিমাগার কর্তৃপক্ষ কেন নির্দিষ্ট তারিখ বেঁধে দিয়ে মাইকিং করছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available